
আমরা অনেকেই মনে করি, মানুষ চিনতে বহু সময় লেগে যায়। অনেকেরই ধারণা, একটা মানুষকে চিনতে হলে আমাদের তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাতে হবে। তাঁর সঙ্গে হৃদয় ভাঙার মতো অভিজ্ঞতা, ছোটবেলায় পাওয়া মানসিক আঘাতের কথা শেয়ার করতে হবে, কিংবা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গিয়ে বিপদে পড়তে হবে। আদতে কি তা–ই?
বিষয়টি ঠিক এত কঠিনও নয়।
একটা মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে মাত্র ১০ সেকেন্ড সময় নিন। এমনকি যদি তিনি স্পষ্টবাদী হন, তাহলে আরও কম সময়েই আপনার যা কিছু জানা প্রয়োজন, জানতে পারবেন।
•
১. কে কীভাবে ঘরে প্রবেশ করেন:
অনেকে ঘরে ঢোকার সময় এত তাড়াহুড়া করেন যে দেখলে মনে হয়, তাঁরা মনে করছেন, তাঁরা ঘরে ঢুকলেই সবাই হাততালি দিয়ে উঠবে। আবার অনেকে এমনভাবে ঢোকেন, যেন সবার নজর এড়াতে চাইছেন। কেউ কেউ আবার ঘরে ঢুকেই এমনভাবে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন, যেন তাঁরা খুব উন্নতমানের রোবট, খুব সূক্ষ্মভাবে স্ক্যান করে দেখছেন, কার সঙ্গে একটু কথা বলা যায়। ঘরে ঢোকার ধরনের ওপর ভিত্তি করে মানুষকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—
• যাঁরা মনোযোগ চান: তাঁরা খুব বেশি নড়াচড়া করেন। খুব জোরে কথা বলেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আগে নাটকীয়ভাবে একটু থামেন। এ ধরনের মানুষেরা বহির্মুখী কিংবা তাঁদের কোনো ব্যাপারে স্বীকৃতি বা মনোযোগ পাওয়ার প্রয়োজন খুব বেশি।
• যাঁরা অদৃশ্য হয়ে যেতে চান: তাঁরা এক কোনায় পড়ে থাকেন। ধরতে গেলে কোনো শব্দই করেন না। হয়তো তাঁরা উদ্বিগ্ন থাকেন, হয়তো মানুষজন পছন্দ করেন না।
• এই দুইয়ের মাঝামাঝি: এ ধরনের মানুষেরা ভালোভাবেই ঘরের পরিবেশের সঙ্গে মিশে যান। তাঁদের দেখে মনে হয় না যে তাঁদের কিছু প্রমাণ করার প্রয়োজন আছে। তাঁরা ঘরে উপস্থিত অন্যদের সম্ভাষণ জানান, সরাসরি চোখের দিকে তাকান, কিন্তু তাঁদের আচরণ দেখে মনে হয় না যে তাঁরা কারও মনোযোগ পাওয়ার জন্য খুব বেশি চেষ্টা করছেন। এ ধরনের মানুষ সংখ্যায় সবচেয়ে কম।
২. যখন কেউ তাঁদের প্রতি মনোযোগ দেয় না, তখন তাঁরা কী করেন:
মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলে প্রায় সবাই স্বাভাবিক আচরণ করে। কিন্তু যখন সবার মনোযোগ থাকে না, তখন একটা মানুষ কী করে? এটা খেয়াল করলেই তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়।
• কথা শেষ হওয়ামাত্রই কি তারা সব মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন?
• যখন তাঁদের নিয়ে কোনো কথা হয় না, তখনো কি তাঁরা আলোচনায় মনোযোগ ধরে রাখেন?
• যখন অন্য কেউ কথা বলতে শুরু করে, তখন কি তাঁরা বিরক্ত হন?
যাঁরা কেবল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেই নিজেদের জাহির করেন, তাঁদের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। যাঁরা শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাঁদের ক্রমাগত স্বীকৃতি খোঁজার প্রয়োজন হয় না।
৩. কীভাবে তাঁরা আলোচনায় অংশ নেন:
আপনি হয়তো কখনো এমন কারও সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, যিনি পুরো আলোচনায় আপনাকে একটি প্রশ্নও করেননি। আবার হয়তো এমন কাউকে পেয়েছেন, যিনি কথার মাঝখানেই আপনাকে বারবার থামিয়ে দিয়ে একা একাই বকবক করে গেছেন। আপনি হয়তো আপনার একটা ছোটখাটো সাফল্যের কথা বললেন; দেখা গেল, তিনি আপনার চেয়েও দ্বিগুণ ভালো কিছু করেছেন! এসব ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখুন।
• উপভোগ্য কথোপকথন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতে থাকে। শুধু একজনের দ্বারা পুরো আলোচনাটি পরিচালিত হয় না।
• অহংকারী মানুষেরা প্রতিটি মিথস্ক্রিয়াকে একক পডকাস্ট পর্বের মতো দেখেন।
৪. ছোট ছোট প্রতিশ্রুতি কি রাখেন?
বড় বড় প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই। ছোট ছোট প্রতিশ্রুতিগুলোর দিকে খেয়াল করুন।
• তাঁরা যদি বলেন, ‘আজকে এসএমএস পাঠাব।’ তখন কি সত্যিই পাঠান? কিংবা যখন বলেন, ‘আমি তোমাকে লিংকটা পাঠাব।’ পরে কি আর পাঠান?
• যদি বলেন, ‘চলো, একদিন একসঙ্গে কফি খাই।’ এটা কি শুধু ভদ্রতার খাতিরেই বলা? যদি এসব ছোট ছোট কথা দিয়েই তাঁরা কথাগুলো না রাখেন, তাহলে আসল দায়িত্বগুলো তাঁরা কীভাবে পালন করবেন?
৫. যাঁরা বিনিময়ে কিছুই দিতে পারবেন না, এমন মানুষদের সঙ্গে তাঁদের আচরণ কেমন:
একটা মানুষের চরিত্র বোঝার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
• একটা মানুষ ওয়েটার, ক্যাশিয়ার, দারোয়ান, কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি, এমনকি রাস্তার ভিক্ষুকের সঙ্গেও কেমন আচরণ করেন, তা খেয়াল করুন।
• যখন গল্পের আসরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি থাকেন না, তখন তাঁরা কীভাবে কথা বলেন, তা-ও খেয়াল করুন।
• যদি কেউ এমন লোকদের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ বা কোনো রাখঢাক ছাড়াই খারাপ আচরণ করেন, যাঁদের কাছ থেকে তাঁর কিছু পাওয়ার সুযোগ নেই, তাহলে তিনি খুব একটা ভালো মানুষ নন।
৬. তাঁরা কি নীরব থাকেন, নাকি রেগে যান?
যাঁরা সামান্যতম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলেই রেগে যান, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা খুব ক্লান্তিকর। কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত হতে পারছি না’—কথাটা শোনামাত্রই এমন আচরণ করতে শুরু করেন যেন আপনি তাঁর বিশাল কোনো ক্ষতি করে ফেলেছেন। আপনি মৃদুভাবে তাঁদের গঠনমূলক সমালোচনা করুন, দেখবেন, পাল্টা তাঁরা আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ আবার অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য আপনাকেই দোষারোপ করতে শুরু করবেন। বলবেন, ‘আপনিই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।’
যদি কেউ ছোটখাটো বিষয়ে সামান্য মতবিরোধই সহ্য করতে না পারে, মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না, তাহলে ভেবে দেখুন, আসল সংকটের সময় তাঁরা কী করবেন!
৭. তাঁরা কীভাবে আলোচনা শেষ করেন:
আলোচনার ইতি কীভাবে টানা যায়, তা নিয়ে অধিকাংশ মানুষ খুব বেশি ভাবে না। কিন্তু বিষয়টি থেকে একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
• হঠাৎ করে আলোচনা শেষ করা: তাঁরা হুট করে কথা শুরু করেন, হুট করেই শেষ করেন। কোনো বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না।
• আনাড়ি কথাবার্তা: কেউ কেউ আছেন, কথা বলতে বলতে হঠাৎই তাঁদের মনে হয়, এবার থামা উচিত। তারপর তাঁরা আরও কিছুক্ষণ অর্থহীনভাবেই বকবক করতে থাকেন।
• কথা একবার শুরু করলে শেষ করতে না চাওয়া: এ ধরনের মানুষের কথা যেন থামতেই চায় না! তাঁরা আলোচনা অহেতুক প্রলম্বিত করেন।
• সুন্দরভাবে আলোচনা শেষ করা: অনেকে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা শেষ করেন। তাঁদের শেষ কথাগুলো একটি দৃঢ় ছাপ রেখে যায়। যাঁরা সামাজিকভাবে নিজেদের উপস্থিতি নিয়ে সচেতন, তাঁরা এভাবেই প্রতিটি আলাপ শেষ করেন।
•
অনেক মানুষ ভাবে, তারা নিজেদের আসল স্বভাব লুকাতে পারে, কিন্তু আদতে তা সম্ভব নয়। তাঁদের কথাবার্তা, হাঁটাচলা, তাঁদের কাছে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের সঙ্গে আচরণ—এসব দেখে ধারণা করা যায় তাঁরা আদতে মানুষ হিসেবে কেমন। এসব লক্ষণ ধরতে পারলে আপনি কম সময়েই একটা মানুষকে চিনতে পারবেন।
_________________
সূত্র: মিডিয়াম ডট কম