পাহাড়, ঝরনা, ঝিরি ও কৃত্রিম লেক সমৃদ্ধ বৈচিত্রময় খাগড়াছড়ি হতে পারে আপনার ভ্রমণের উপযুক্ত স্থান। দিনের পর দিন পাহাড়ের রানি খ্যাত খাগড়াছড়িতে ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। শীতের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পর্যটকদের এমন উপচেপড়া ভিড় থাকবে বলে জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
খাগড়াছড়ির আলুটিলার রহস্যময় সুড়ঙ্গ, জেলা পরিষদ পার্ক বা ঝুলন্ত ব্রিজ, তারেং, রিছাং ঝরনাসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও পর্যটকে মুখরিত হবে খাগড়াছড়ির পর্যটন স্পটগুলো। শীত মৌসুমে বাড়তি ব্যবসার আশা করছে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা। পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে নিয়োজিত থাকবে ট্যুরিস্ট পুলিশ। এছাড়া সাজেকগামী পর্যটকদের ভ্রমণের সহায়তা করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
পর্যটকদের বিনোদনের কথা চিন্তা করে খাগড়াছড়ির রহস্যময় সুরঙ্গ কেন্দ্রিক আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রের সংস্কার করেছে জেলা প্রশাসন। এমনটি জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাবলু ত্রিপুরা বলেন, ‘শীতকাল মানেই পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়। পর্যটনকেন্দ্রের কয়েকটি স্থানে নতুন করে ভিউপয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে। শৌচাগার সংস্কার করা হয়েছে।’
খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেলের ব্যবস্থাপক এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ মৌসুমে খাগড়াছড়িতে প্রচুর পর্যটক এসেছে। পুরো শীত মৌসুমজুড়ে পর্যটকদের সমাগম হবে। আগত পর্যটকদের সেবা দিচ্ছে খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেল।’
খাগড়াছড়ি-ঢাকা সড়কের পাশে অবস্থান ‘আলুটিলার রহস্যময় সুরঙ্গ’। পাহাড়ের চূড়া থেকে ২৬৬টি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই সেই স্বপ্নীল সুরঙ্গমুখ। প্রায় ২৮২ ফুট দৈর্ঘের আলুটিলা সুরঙ্গ যেন বিধাতার অনন্য সৃষ্টি। অনবদ্য রহস্যের উৎস প্রাকৃতিক এ সুরঙ্গের ভেতরটা দেখলে অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে হতবাক হতে হবে যে কাউকেই। এ গুহায় প্রবেশ করে অন্য প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় আপনিও হতে পারবেন দুঃসাহসিক এক অভিযাত্রী। আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র ও রহস্যময় গুহা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে প্রকৃতির আরেক সৃষ্টি ‘রিছাং ঝরনা’। বৃষ্টিহীন শীতের সকালে পাহাড়ের চূড়া থেকে স্বচ্ছ পানির অব্যাহত ঝরনাধারা নিঃসন্দেহে আপনাকে আন্দোলিত করবে। একজন ভ্রমণপিপাসু হিসেবে আপনিও হতে পারেন ‘রিছাং ঝরনা’র সাক্ষী।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়কের মাইসছড়ি এলাকার নুনছড়ি মৌজায় সমতল ভূমি হতে প্রায় সাতশ ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় ‘দেবতা পুকুর’ রূপকথার দেবতার আশীর্বাদের মতোই সলিল বারির স্রোতহীন সঞ্চার। যা আপনাকে মুহূর্তের মধ্যেই বিমোহিত করবে। খাগড়াছড়ি জেলা শহরের খুব কাছাকাছি জিরো মাইল সংলগ্ন ২২ একর ভূমির উপর গড়ে ওঠা ‘জেলা পরিষদ পার্ক’। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের মালিকানাধীন এ পার্কের বিশেষ আকর্ষণ রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতুর আদলে তৈরি ‘ঝুলন্ত সেতু’।
খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদীর কোলে জেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত ‘হেরিটেজ পার্ক’। পর্যটন পিপাসুদের কাছে ‘হেরিটেজ পার্ক’ হয়ে উঠেছে নতুন ঠিকানা। পর্যটন মোটেলের বিপরীতে সৌন্দর্য মণ্ডিত ও নান্দনিক হেরিটেজ পার্কটি পাহাড় ঘেরা প্রকৃতিতে বসে চাঁদনি রাতের দৃশ্যপটে দেখার সুযোগ করে দেবে।
খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশমুখে খাগড়াছড়ি-ফেনী আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’ধারে ঠাঁই করে নিয়েছে ‘রামগড় চা বাগান’। খাগড়াছড়িতে আসা ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এটি সদা প্রস্তুত। ‘রামগড় চা বাগান’ আপনার ভ্রমণের সার্থকতা এনে দেবে। খাগড়াছড়ির প্রবেশদ্বার রামগড় উপজেলা সদরে ইংরেজি ডব্লিউয়ের অনুরূপ প্রায় ২৫০ মিটার লম্বা নান্দনিক হ্রদ ‘রামগড় লেক’। রামগড় লেকের উভয় পাশে যোগাযোগের জন্য মাঝখানে রয়েছে সুদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু। রামগড় লেক ঘেঁষে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি ভাস্কর্য। এ লেকটি হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য এক অনন্য স্থান।
খাগড়াছড়ির সীমান্ত শহর রামগড়। তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) জন্মস্থান রামগড়। এখানে রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান ও স্থাপনা। রয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভাজনকারী ফেনী নদী। যা আপনাকে ইতিহাস জানারও সুযোগ করে দেবে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরে বিনোদনমূলক পার্ক ‘জলপাহাড়’ হতে পারে আপনার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। নাগরদোলা ও ময়ূরপঙ্খী নৌকা হয়ে উঠবে আপনার বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। জলপাহাড়ের সুবিশাল লেক আপনাকে বাড়তি আনন্দ দিবে নিঃসন্দেহে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে এত বড় সুযোগ শহরের পাশে আর কোথাও নেই।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে সোজা উত্তরে ভারতের সীমান্তবর্তী ‘ভগবান টিলা’। জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে এর কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ৮৫ কিলোমিটার। সবুজের বুকে এ টিলা যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া পর্বত রূপসী। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ৬শ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এ টিলায় রয়েছে বিজিবির সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। সবুজে ঘেরা বাঁশের ঝোঁপ, নাম না জানা নানা ধরনের পার্থিব ডাক আর পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনার কল কল জীবন্ত শব্দ- সবকিছু মিলিয়ে হারিয়ে যাওয়ার এক অনন্য স্বপ্নপূরী ‘ভগবান টিলা’।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদরের খুব কাছাকাছি আলুটিলা-বটতলী এলাকায় এ প্রাচীন শতায়ুবর্ষী বটবৃক্ষটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয়, এ যেন দর্শনীয় আশ্চর্যের কোনো উপাদান। দুই একরের বেশি ভূমির উপরে এ গাছটি হাজারো পর্যটকের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ডালপালা মাটিতে মিশে কালের পরিক্রমায় একেকটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ‘তৈদুছড়া ঝরনা’। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা তৈদুছড়াকে এনে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। আশ্চর্যরকম আর অনিন্দ্য সুন্দর এক জলপ্রপাত বিধাতা যেন তার মহিমান্বিত হাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন গহীন অরণ্যে। যা একবার দেখলে বারবার ছুটে আসতে চাইবেন। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা সদর থেকে যাওয়া যাবে তৈদুছড়া ঝরনায়। অপার সৌন্দর্যের আরেক নাম শিবছড়ি পাহাড়। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে দেওয়ানপাড়া এলাকায় অবস্থিত ‘শিবছড়ি পাহাড়’। পাহাড়ি ছড়া, নালা আর গভীর অরণ্য পেরিয়ে বোয়ালখালী নদীর পাশ ঘেঁষে সুউচ্চ পাহাড়ি ঝরনা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত বিভিন্ন পাথরের রূপ পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই।
পার্বত্য খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় দেখতে পাবেন দৃষ্টিনন্দন ‘শান্তিপুর অরণ্য কুটির’। পাহাড়ি গাছ-গাছড়ায় ঘেরা পানছড়ি শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বুদ্ধ মূর্তি। ‘শান্তিপুর অরণ্য কুটির’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। ১৯৯৯ সালে নির্মিত ৫০ ফুট উচ্চতার এ বুদ্ধ মূর্তি আপনাকে আকৃষ্ট করবে।
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ১০৯ কিলোমিটার। ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কলাবাগান থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে খাগড়াছড়িতে। এতে আপনাকে জনপ্রতি ৫২০-৫৫০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। আর এসি বাসে ভাড়া লাগবে ৮৫০-১০০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে আসতে হলে আপনাকে খাগড়াছড়ি অভিমুখী গাড়িতে উঠতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি আসতে জনপ্রতি ১৮০-২২০ টাকা ভাড়া গুনতে হবে।